সম্প্রতি প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরসহ কয়েকজনের সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু দেশের মানুষকে সড়ক পথের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোড়িত ও ক্ষুব্ধ করেছে। এ সময় কালে চট্টগ্রাম ও অন্যান্য কিছু জায়গায় চাঞ্চল্যকর সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। দুর্ঘটনার যে বিবরণ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে মনে হয় এসব দুর্ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত। সড়ক পথে সাধারণ কতগুলি নিয়মকানুন আইন মেনে চললে হয়তো এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটত না। গাড়ি চললে কিছু দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু সেটা যদি দুর্ঘটনা বা এ্যাক্সিডেন্ট না হয়ে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিনত হয়, যদি সংশ্লিষ্টদের চরম অবহেলার কারণে এমন ঘটে তা হলে সেগুলিকে হত্যাকাণ্ড বলাই হয়ত সঠিক হবে।
অনেকেই এখন এসব দুর্ঘটনার কারণ, প্রতিকারের উপায়, যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপর্যয় এসব নিয়ে আলোচনা করছেন। অতীতেও বিভিন্ন দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে আলোচনার ঝড় বয়ে গেছে। সরকার কিছু হুঙ্কার দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত সব কিছু স্থিমিত হয়ে এসেছে। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই গেছে।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কোন একটা সমস্যাকে বড় করে দেখে সেটার সমাধানের উপর জোর দেয়া হয়। দেশের অন্যান্য সমস্যার ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা বা সড়ক ব্যবস্থায় নৈরাজ্যেরও পেছনে কেবল একটি নয় আছে নানাবিধ কারণ এবং তাদের পারষ্পরিক সম্পর্ক। সেগুলি সামগ্রিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ না নিলে কেবলমাত্র দুই একটি পদক্ষেপ সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কোন একটা সমস্যাকে বড় করে দেখে সেটার সমাধানের উপর জোর দেয়া হয়। দেশের অন্যান্য সমস্যার ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা বা সড়ক ব্যবস্থায় নৈরাজ্যেরও পেছনে কেবল একটি নয় আছে নানাবিধ কারণ এবং তাদের পারষ্পরিক সম্পর্ক। সেগুলি সামগ্রিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ না নিলে কেবলমাত্র দুই একটি পদক্ষেপ সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না।
সড়ক দুর্ঘনার জন্য ড্রাইভারকে প্রধানতঃ দায়ী করা হয়। গাড়ি চালায় ড্রাইভার। কোন কোন ক্ষেত্রে হয়ত তার দোষ ত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু সে যে গাড়ি চালায়, সে গাড়িও হতে পারে ত্রুটিপূর্ণ,আনফিট। রাস্তাও হতে পারে ত্রুটিপূর্ণ। হাই ওয়েতে বহু পয়েন্ট সনাক্ত করা হয়েছে যেগুলি দুর্ঘটনাপ্রবণ। এছাড়া ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সমস্যা, রোড সাইন, পথচারী পারাপারের সমস্যা, রাস্তা বেদখল, বাজার হাট, রাস্তার মোড়ে, আইল্যান্ডে গাছের কারণে ড্রাইভারের দৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা প্রভৃতি নানাবিধ ও সমস্যার কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু “যত দোষ নন্দ ঘোষ” এই মনভাব সমস্যার প্রকৃত সুরাহার পথে একটা বাধা । অতীতে ড্রাইভারদের শাস্তি বৃদ্ধি করার জন্য আইন করা হয়েছিল, ফাঁসির দাবি উঠেছিল কিন্তু তাতে সড়ক দুর্ঘটনা কমে নি।
ত্রুটিপূর্ণ ড্রাইভিংয়ের জন্য ড্রাইভারদের যেটুকু শাস্তির বিধান আছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, সেই শাস্তিরও ব্যবস্থা হয় না। চাঞ্চল্যকর দুর্ঘটনা মামলাগুলি একটি একটি করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে অনেক মামলাই শেষ পর্যন্ত চালান হয় নাই অথবা মামলা পরিচালনায় দক্ষতার অভাবে কোন শাস্তি বিধান করা যায় নি। অনেক পুলিশ ঘুষ নিতে যত দক্ষ, মামলা পরিচালনা করতে ততটা নয়। অধিকাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দালালরা থানায় গিয়ে টাকা পয়সা লেনদেন করে সব কিছু নিষ্পত্তি করে দেয়। কিছু দুর্নীতিপরায়ন শ্রমিক ও মালিক নেতা এর সাথে জড়িত থাকে। থানা পুলিশ প্রশাসনের সাথে দালাল ও এই সব দুর্নীতিবাজদের যোগসাজশ খুবই গভীর। শ্রমিক ও মালিকদের থেকে চাঁদা তুলে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে মাসিক ও দৈনিক হারে অর্থ দেয়া হয়। এইভাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের খবর আমরা বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে পাই। অপরাধীর যখন শাস্তি হয় না তখন অপরাধ আরো বেড়ে যায়। অপরাধী বেপরোওয়া হয়ে ওঠে। আর বন্ধ হয়ে যায় তার সংশোধিত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি। কাজেই সর্বপ্রথম প্রতিটি অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে সে ড্রাইভারই হোক, মালিক হোক অথবা সড়ক ও পরিবহণ ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট যে কোন সংস্থা বা ব্যাক্তি হোক। সবার কাছে যেন এই বার্তা পৌঁছে যায় যে শুধু দুর্ঘটনা নয় ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে বা সড়ক পথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যার্থ হলে,শাস্তি পেতেই হবে। কোন অবস্থায় অপরাধীদের নিস্তার নেই। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট কেনেডীর ভাই বা লন্ডনে প্রিন্সেস ডায়নাও ট্রাফিক আইন থেকে রেহাই পান নি। সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষের যারা এ ব্যাপারে উপযুক্ত শাস্তি বিধান নিশ্চিত করতে না পারবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।দেশে ট্রাফিক আইন আছে। হুঙ্কার আছে কিন্তু ট্রাফিক আইনের কোন প্রয়োগ নেই। অনেকেই ট্রাফিক আইনের কোন পরোয়াই করে না। ট্রাফিক সিগনাল অমান্য করে গাড়ি চলে যায়, ট্রাফিক পুলিশ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। ঢাকায় এখন যে ট্রাফিক পুলিশ তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। জরুরী ভিত্তিতে প্রশিক্ষিত ট্রাফিক পুলিশ কমপক্ষে তিন গুণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। আইন অমান্যকারী গাড়িকে তাড়া করার জন্য ট্রাফিক পুলিশকে আরও ওয়ারলেস এবং মোটর সাইকেল প্রভৃতি দেওয়া দরকার। প্রায় ৪২ কোটি টাকা খরচ করে সিগন্যাল ব্যবস্থাকে আধুনিক করা হয়েছে। রাস্তায় নিয়ন বাতির ডিসপ্লে “ট্রাফিক আইন মেনে চলুন” সরকারী টাকা লুটপাটের নানা হাস্যকর ফন্দি বটে!
ভূয়া লাইসেন্স একটা বড় সমস্যা। আমার তো মনে হয় অর্ধেকেরও বেশি ড্রাইভিং লাইসেন্সই ভুয়া। ভূয়া লাইসেন্স আটকে দিলে দেশের অর্ধেক গাড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। ভুয়া লাইসেন্স প্রদাণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং এর সাথে জড়িতদের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সাথে বৈধ লাইসেন্স প্রদাণ প্রক্রিয়া দূর্নীতি ও জটিলতা মুক্ত করতে হবে। আসল লাইসেন্সধারী অনেকেই যারা কোন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নেয় তা অনেক ক্ষেত্রেই মামুলী ধরনের। এসব প্রতিষ্ঠানের লোকজন অনেকেই লাইসেন্সের দালালী করে। শিক্ষানবিশদের সাথে এদের চুক্তি থাকে যে প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্স করে দেয়ার বিনিময়ে তারা কত টাকা পাবে। বাংলাদেশে অনেক সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সার্টিফিকেট ব্যাবসা চলার নজির আছে। ড্রাইভিং স্কুলগুলোর উপরে সরকারী নিয়ন্ত্রণ ও পরিদর্শণ জোড়দার করা দরকার।
আরবান ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানিং নামে কত শত কোটি টাকা পানিতে ফেলা হলো। কাজের কাজ কিছুই হলো না। ঢাকা শহরে রোড ডিভাইডার, গোলচত্বর যতবার ভাঙ্গা হয়েছে তা দিয়ে ঢাকা-আরিচা বা অন্যান্য হাইওয়েতে ডিভাইডার তৈরি করা যেত। জরুরী ছোট ছোট কম ব্যায়সাপেক্ষ কাজ বাদ দিয়ে, উড়াল সেতু, উড়াল সড়ক, ওভার পাস প্রভৃতি গালভরা নামের মেগাপ্রজেক্ট নিয়েই ব্যস্ততা বেশি। রাস্তা দখলমুক্ত করা, নিয়মিত মেরামত করা,প্রয়োজনীয় রোড সাইন, রোড পেইন্টিং, নতুন রাস্তা তৈরির দিকে নজর নেই। চলছে কোটি কোটি টাকার ধান্দাবাজী।
এছাড়া অনেক আসল লাইসেন্সও ভূয়া হয়ে যায়। যেমন লাইসেন্সের টাকা বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা হয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সরকারী তহবিলে জমা পরে নাই। ভলিউমে নাম উঠেনি। এ ভাবে ২০ হাজার লাইসেন্স বিএনপি আমলেই ভূয়া হয়ে গেছে। ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন বা লাইসেন্স বাবদ কোটি কোটি টাকা ডাকঘর বা অন্যত্র থেকে উধাও হয়ে গেছে। এসব খবরাখবর পত্র পত্রিকায় বিস্তারিত বেরিয়েছে। এসব দুর্নীতিবাজ, লুটপাটকারীদের কেউ শাস্তি পেয়েছে কিনা আমরা জানি না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় লুটেরাদের কী হয়েছে তাও আমরা জানি না। তত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন-রক্ষক নামে বন-ভক্ষক, যার বালিশে, তোষকে সর্বত্র টাকার বান্ডিল পাওযা গিয়েছিল তারও খবর আমরা জানি না। বাংলাদেশটা যেন চোর বাটপারদের জন্য অভয় অরণ্য।
আসল লাইসেন্স পেতে হলে শুধু ভাল ড্রাইভিং জানলেই হয় না, ঘুষ দিতে হয়। লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি আসলেই জটিল। ফলে অন্যপথে লাইসেন্স সংগ্রহে উৎসাহিত হয়। এই ব্যবসায় যে লক্ষ লক্ষ টাকা লুটপাট হয় তার ভাগ যায় সব জায়গায়। নকল লাইসেন্সধারী ড্রাইভার দুর্নীতিবাজ পুলিশের কাছে কামধেনুর মতো। যখন দুধ দরকার নকল লাইসেন্স ধরলেই হলো। রেট বাঁধা। পাঁচ শ’ টাকা ঘুষ।
তাহলে কীভাবে নকল লাইসেন্স বন্ধ করা যায়? কীভাবে অদক্ষ ড্রাইভারদের গাড়ি চালান থেকে বিরত রাখা যায়? প্রথমতঃ বৈধ লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধ করতে হবে। বিদেশের আধুনিক পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে শিক্ষা নেয়া যায়। পরীক্ষার ক্ষেত্রে ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়ার সাথে জন প্রতিনিধিকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ভূয়া লাইসেন্স প্রদান, লাইসেন্স ফিটনেস ইত্যাদি নিয়ে দুর্নীতির সাথে জড়িত বিআরটিএ ডাকঘর সহ প্রশাসনের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
বিমানে একজন পাইলটকে প্রশিক্ষণ দিতে কত লাখ টাকা ব্যয় হয় ! তারপরও সামরিক বেসামরিক বিমানে দুর্ঘটনা ঘটলে জাতীয়ভাবে শোক প্রকাশ করা হয়। পাইলটকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। একজন ড্রাইভার তৈরি করতে সরকার কত টাকা খরচ করে? এক টাকাও না। তারা সবাই প্রায় স্বশিক্ষিত। বরং লাইসেন্স করতে তারা সরকারকেই টাকা দেয়। জাপানে সড়ক পরিবহন থেকে সরকার যা আয় করে তার সবটুকুই সড়ক পরিবহন খাতে ব্যয় হয়।
আমাদের দেশে সামান্য অংশ ব্যয় হয় মাত্র। সরকারের উদ্যোগে ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ইতোমধ্যে যারা অবৈধ লাইসেন্স নিয়ে দীঘর্দিন ধরে গাড়ি চালাচ্ছে তাদেরকে দৈনিক ভাতা দিয়ে শর্ট কোর্সে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ইদানিং কিছু কিছু প্রশিক্ষণ হচ্ছে কিন্তু তা সমুদ্রে বারিবিন্দুর মতো। দেশে রিকশা চালকদের সংখ্যা বিরাট। এরা অভাবের তাড়নায় গ্রাম থেকে এসে সদরে উঠেই রিকশা ধরে। রিকশা চালাবার অভিজ্ঞতা বা ট্রাফিক আইন সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। রিক্সা চালকদের জন্য গণপ্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা দরকার। রিক্সা চালকরা সরকারকে যে অর্থ দেয় সে তুলনায় প্রাইভেট কার দেয় অতি সামান্য। সরকারকে রিক্সা চালকদের জন্য কিছু ব্যয় করতে হবে। রিক্সা চালকদের প্রতি ‘দূর হ’ মনভাব পরিত্যাগ করতে হবে। প্রাইভেট কার রাস্তার ৩৪ ভাগ জায়গা দখল করে যাত্রী নেয় শতকরা ৯ ভাগ আর রিক্সা ৩৮ ভাগ জায়গা নিয়ে যাত্রী পরিবহন করে শতকরা ৫৪ ভাগ। গাড়ির চালকদের দুর্ঘটনার জন্য প্রায়শই দায়ী করা হয়। যে চালকের হাতে কোটি টাকার গাড়ি এবং শত প্রাণ নির্ভর করে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার কথাও আমাদের ভাবতে হবে। তার জন্য ভাল থাকা, খাওয়া পরার ব্যবস্থা আছে কিনা, বিশ্রামের ব্যবস্থা আছে কিনা দেখতে হবে।
মুরুব্বীদের দেখতাম গাড়ি নিয়ে কোথাও গেলে গন্তব্যে পৌঁছেই প্রথমে ড্রাইভারের খাওয়া এবং ঘুমাবার ব্যবস্থা আগে করতেন। কারণ ড্রাইভারের ভাল খাওয়া না হলে, শান্তিতে ঘুম না হলে নিরাপদে গাড়ি চলাটা নিশ্চিত নয়। সম্প্রতি কিউবাতে গিয়ে বাসে হাভানা থেকে গুয়ানতানেমোর মার্কিন ঘাঁটির কাছে গিয়েছি। ১২ ঘণ্টার সফর। ৬ ঘণ্টার পর ড্রাইভার পেছনের সিটে বসে ঘুমিয়ে পড়ল। আর একজন গাড়ি চালাল। আমাদের দেশের কাজের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নেই। আইন অনুসারে বিশ্রাম ও ছুটি ছাটাও দেয়া হয় না। আন্তঃজেলা বাসে সারা রাত চালিয়ে ভোরেই আবার গাড়ি চালিয়েই ফিরতে হয় এমন ঘটনাও আছে। টার্মিনালগুলিতে রাত্রী যাপনের ভাল ব্যবস্থা নাই, পরিবেশও নেই। মদ গাঁজার ব্যবসা আর নানা গ্যাঞ্জাম। গোটা ব্যবস্থাই এ রকম। সারা রাস্তা খিস্তি খেউড় চলে। কীভাবে মাথা ঠান্ডা রাখবে ড্রাইভার। সৌদী আরব বা মধ্যপ্রাচ্যে এই বাংলাদেশের ড্রাইভারদেরই সুনাম আছে। কারণ সেখানে সিস্টেমটাই ভাল।
সড়ক দুর্ঘটনার আর একটি বড় কারণ হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন। ঘুষ দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ গাড়ির ফিটনেস আদায় করা হয়। দেশে নানা মডেলের গাড়ি আছে। সে সবের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মডেলের যন্ত্রাংশ আসে না। ফলে এক মডেলের যন্ত্রাংশ আর এক মডেলে মডিফাই করে লাগান হয়। নিয়মের বাইরে চেসিস বাড়িয়ে নেয়া হয়। জরুরী পরিস্থিতিতে সেগুলিতে বিভ্রাট দেখা দেয়, ব্রেক ফেল করে। স্টিয়ারিং ধরে না। গাড়ির ভারসাম্য থাকে না। বাতিল গাড়ি বা ফিটনেস ছাড়া গাড়ি বন্ধ করতে বেশ কয়েকবার অভিযান চলেছে। কিন্তু প্রতিবারই মাঝ পথে তা থেমে গেছে।
সড়ক পরিবহনে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে গেলেই নানা দিক থেকে বাধা আসে। প্রশাসনে পুলিশ ও আমলাদের অনেকেই গাড়ির মালিক। তারা নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এছাড়া দুর্নীতিপরায়ন ও চাঁদাবাজ কিছু মালিক নেতা, শ্রমিক নেতা এবং ঘুষখোর সরকারী কর্মচারীদের একটি মাফিয়া চক্র গড়ে উঠেছে। তারা ভূয়া লাইসেন্স ও ত্রুটিপূর্ণ গাড়ির বিরুদ্ধে যখন অভিযান চালায় অথবা ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা হয় তখন সর্বশক্তি দিয়ে তারা বাধা সৃষ্টি করে। এরশাদের সামরিক শাসন থেকে শুরু করে এই মাফিয়া চক্র ক্রমেই প্রবল শক্তিধর হয়ে উঠেছে। এদের চাঁদাবাজী ও সন্ত্রাস সম্পর্কে এবং জনৈক মন্ত্রীর যোগসাজশ সম্পর্কে সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ওই মাফিয়ার হাতে সাধারণ মালিক শ্রমিক ও তাদের প্রকৃত নেতারা জিম্মি। সরকারও এদের সামনে অসহায় মনে হয়। অতীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঐসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিয়েছে। ওরা যেখানে ইচ্ছা বিআরটিসির বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়। বাস পরিবহনের স্বার্থে যাত্রীদের জন্য সুবিধাজনক সময়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়। শুধু সড়ক পরিবহন নয় দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই ধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মনে হয় দেশটা এখন মগের মুল্লুক।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে গোটা সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে নৈরাজ্য বিরাজ করছে তা দূর করতে হবে। সারা দেশে বিরাজমান নৈরাজ্যকর পরিবেশ দূর করতে হবে। কোন একটি দুটি পদক্ষেপ নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার কোন ম্যাজিক সমাধান নেই। এর সমাধান করতে হলে গোটা সমস্যাকে তার সামগ্রিকতায় দেখতে হবে এবং জরুরী ভিত্তিতে সমাজের সংশ্লিষ্ট সকল অংশকে নিয়ে বহুমাত্রিকতায় তার সমাধানে ব্রতী হতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট প্রভৃতি সমস্যা এখন এত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যে উচ্চ পর্যায়ে শক্তিশালী স্ট্যান্ডিং কমিটি ২৪ ঘন্টা মনিটরিং না করলে সমস্যার কোন সমাধান করা যাবে না।
বাংলাদেশের সমাজ জীবনে আজকাল লেবেলিং করার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠছে। গোটা সমাজ যেন নানা বিবদমান ও পরষ্পর বিরোধী গোষ্টী ও গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। আমরা আমাদেরকে বিভিন্ন গোষ্টীতে ভাগ করে একটা লেবেল এটে দিতে পছন্দ করি, ওদের সবাইকে একই পাল্লায় ব্রাকেট বন্দী করি। সিভিলিয়ান অথবা মিলিটারী, পাবলিক অথবা পুলিশ, যাত্রী অথবা চালক, ডাক্তার অথবা রোগী, রাজনীতিবিদ অথবা সুশীল সমাজ, এমনি নানা ভাগই যেন হয়ে যাচ্ছে প্রধান। আমি যে ভাগে সে ভাগের কোন দোষ নেই, আমি অভ্রান্ত, দায়ী অপরপক্ষ। ওদের প্রতি যত ঘৃণা আর বিদ্বেষ।
শেক্সপীয়ারের অনবদ্য প্রেম কাহিনী, রোমিও এন্ড জুলিয়েট। মন্টেগু ও ক্যাপুলেট এই দুই বিবদমান পারিবারিক গোষ্টীর প্রেমিক যুগলের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর তাদের শবযাত্রার শেষে রাজা আক্ষেপ করে বলছেন, দেখো তোমাদের ঘৃণা কীভাবে তোমাদের আনন্দকে হত্যা করেছে…..আমিও তোমাদের বিরোধ নিষ্পত্তি করি নি…..আমরা প্রত্যেকেই শাস্তি পেয়েছি। “All are punished”.
আজ পারস্পরিক লেভেলিং, দোষারোপ ও ঘৃণার কারণে আমাদের সবাইকেই শাস্তি পেতে হচ্ছে। আমাদের সবারই নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন ঘটনায়, দূর্ঘটনায় আমাদের প্রিয় স্বদেশ বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছে। বিদ্বেষ এবং দোষারোপ ছেড়ে আমাদের সমস্যার মূল কারণগুলি দূর করতে হবে সবাই মিলে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,
”ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি?
মাথা কর নত,
এ আমার, এ তোমার পাপ।”
”ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি?
মাথা কর নত,
এ আমার, এ তোমার পাপ।”